জুলাই অভ্যুত্থানে হাজারো ছাত্র-জনতার প্রাণ নেওয়ার পর ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও পলাতক, দেশ ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে গুঞ্জন নতুন করে, নতুন নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করতে পারে আওয়ামী লীগ। তথাকথিত পরিচ্ছন্নদের দিয়ে ফের দেশের রাজনীতিতে প্রবেশের আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’।
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগ থাকবে, কিন্তু নেতৃত্বে আর থাকবেন না শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নেতাদেরও বাইরে রাখা হবে। পরিচিত কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীকে সামনে রেখে ‘পরিচ্ছন্ন’ বা ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে একটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
তবে জুলাই-আগস্টের পর লুকিয়ে এবং পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এই উদ্যোগকে সরাসরি ‘প্রতারণা’ বলছেন। তারা এটিকে দেখছেন, দলকে ধ্বংস করার ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ হিসেবে।
ভারতের কূটনৈতিক মহলের একাংশও মনে করছেন, পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে এ ধরনের একটি দল গঠিত হলে সেটা ভারতের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না। কারণ এই প্রস্তাবিত নেতৃত্বে থাকা কয়েকজন নেতা পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এবং তাদের ভাবমূর্তিও ‘পরিচ্ছন্নএ প্রসঙ্গে ভারতের এক সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। তবে ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ভারতের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি। সেই দলের নেতৃত্ব যদি পাকিস্তান ঘনিষ্ঠদের হাতে চলে যায়, তা ভারতের জন্য উদ্বেগজনক হবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, সাবেক স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, ঢাকার সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস ও সাবেক সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো নেতাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নতুন করে সংগঠিত হওয়ার পায়তারা করছে। সেই নেতারা শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের শেখ মুজিবুর রহমানের মূল আদর্শের ধারক দাবি করে ভোটের মাঠে নামবেন—এমনটাই পরিকল্পনা বলে জানান হাসনাত।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্রের কথা আমরা আগেই জেনেছি। যারা এমন উদ্যোগ নিচ্ছে, তারা আসলে মানুষকে ধোঁকা দিতেই আওয়ামী লীগের নামে নতুন কিছু তৈরি করতে চায়। কিন্তু সেটা সফল হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৬ সালেও শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আরেকটি আওয়ামী লীগ গড়ার চেষ্টা হয়েছিল। সেবারও ব্যর্থ হয়েছিল। এবারও হবে। এমন নেতা ছাড়া দল টিকবে না, আর এই ষড়যন্ত্রকারীরাও সেটা জানে। তাদের উদ্দেশ্য আসলে আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করা।’
কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, এই ‘রিফাইন্ড’ পরিকল্পনাই এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলের নেতাদের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে—হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, এমনকি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগও মিলবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
তিনি আরও জানান, কলকাতায় আশ্রিত কিছু নেতা এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন এবং অন্যদেরও টানতে চাইছেন। তবে যাদের ‘পরিচ্ছন্ন’ বলা হচ্ছে, তাদের অনেকেই আসলে নানা ব্যবসায় পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই সম্পর্ক বাঁচাতেই তারা এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছেন।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই পরিকল্পনায় বর্তমান নেতৃত্ব এতটাই ভীত হয়ে পড়েছেন যে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ এখন ভার্চুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ২৩টি জেলায় শেখ হাসিনা নিজে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি কর্মীদের বলছেন, ‘আমি এখনো বেঁচে আছি, ফিরে আসব, এবং প্রতিটি নির্যাতনের বিচার করব।’
তিনি আরও দাবি করেন, ‘আমি দেশ ছাড়তে চাইনি, পদত্যাগও করিনি। আমাকে জোর করে দেশছাড়া করা হয়েছে, ষড়যন্ত্র করে আমার সরকার ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’ নয়।
Post a Comment