রাস্তাঘাটে নারীদের গালি দেওয়ার শাস্তি কী?

রাস্তাঘাটে নারীদের গালি দেওয়ার শাস্তি কী?

নারীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে গালি দেওয়া বা কটূক্তি করা, বাংলাদেশে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারি আইন এবং বিশেষ কিছু আইন নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিধান রেখেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্র নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে এবং নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ থাকবে।’ এছাড়া, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের মর্যাদা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তাই, কোনো নারী যদি রাস্তাঘাটে গালাগাল বা হেনস্তার শিকার হন, তবে তা সংবিধানবিরোধী এবং আইনত শাস্তিযোগ্য।

বাংলাদেশের ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ১৮৬০-তে নারীদের প্রতি অপমানজনক আচরণ এবং গালাগাল সংক্রান্ত বেশ কিছু ধারা রয়েছে—

ধারা ৫০৯ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীর শালীনতা ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে কথাবার্তা বলে, অঙ্গভঙ্গি করে বা অন্য কোনো উপায়ে তাকে হেনস্তা করে, তবে তিনি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ধারা ২৯৪ অনুযায়ী, পাবলিক প্লেসে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা বা অশ্লীল কাজ করলে তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

ধারা ৩৫৪ অনুযায়ী, যদি কেউ নারীর শালীনতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে, তবে তার জন্য দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে। এই আইনের আওতায় নারীদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও সরাসরি গালিগালাজের বিষয়ে আলাদা ধারা নেই, তবে যদি গালি দেওয়ার ফলে নারীর মানসিক যন্ত্রণা হয় এবং তা প্রমাণ করা যায়, তাহলে অপরাধী শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।

রাস্তাঘাটের পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডিজিটাল মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তি নারীকে অশ্লীল বা অবমাননাকর ভাষায় গালি দেন, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ধারা ২৫ ও ২৯ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

ধারা ২৫ অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে মানহানিকর বা উসকানিমূলক তথ্য প্রকাশ করলে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

ধারা ২৯ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি ডিজিটাল মাধ্যমে মিথ্যা বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করেন, তবে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায়ে (BNWLA বনাম বাংলাদেশ) যৌন হয়রানির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে এবং প্রতিরোধমূলক নির্দেশনা দেয়। এই রায়ের আলোকে,

  •  রাস্তাঘাটে নারীদের গালাগাল ও হেনস্তা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে।
  • সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা।
  • ভুক্তভোগীরা সরাসরি আদালতে অভিযোগ করতে পারেন।

যদি কোনো নারী রাস্তায় গালাগাল বা কটূক্তির শিকার হন, তাহলে তিনি নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারেন—

১. থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা করা: স্থানীয় থানায় গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে অভিযোগ জানানো যায়।

২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ: নির্দিষ্ট আইনের আওতায় মামলার জন্য এই বিশেষ আদালতে যাওয়া যায়।

৩. সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ: যদি গালাগাল অনলাইনে হয়, তাহলে পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার ইউনিটে অভিযোগ করা যায়।

৪. উচ্চ আদালতে রিট আবেদন: প্রয়োজন হলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায়।

নারীদের রাস্তাঘাটে গালিগালাজ করা শুধু নৈতিকভাবে ভুল নয়, বরং এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার এবং আদালত এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নারীরা যদি এ ধরনের ঘটনার শিকার হন, তবে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সমাজের সকলের দায়িত্ব নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসা।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post