১৬ বছর পর বেরিয়ে এলো পিলখানার ঘটনায় জড়িতদের নাম

 ১৬ বছর পর বেরিয়ে এলো পিলখানার ঘটনায় জড়িতদের নাম

ভিডিও শেষে দেয়া আছে

রাজধানীর পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যার ১৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। দিনটিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় এবার শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসটি পালিত হবে ভিন্ন আঙ্গিকে, যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের নামে তাণ্ডব চালায়। ওই দুদিনে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালকসহ (ডিজি) ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা এবং নারী-শিশু ছাড়া আরও ১৭ জনকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা।

দীর্ঘ এত বছরেও ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা। শনাক্ত হয়নি সেই অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্রকারীরা। উন্মোচন হয়নি হত্যার আসল রহস্য। বিচার নিশ্চিত হয়নি হত্যাকারীদেরও। ঝুলছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটিও।

Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

একক কোনো ঘটনায় এতসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও কোথাও ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল এই ঘটনা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই পটপরিবর্তনের পর বিডিআর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে গঠন হয় ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’। এমন বাস্তবতায় এবার সত্য উন্মোচনের আশার আলো দেখছেন শহীদদের স্বজনরা। কমিশনের তদন্ত শেষ হওয়ার পর সেটি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।

শহীদদের স্বজনরা বলছেন, বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী ও খলনায়কদের রক্ষা করতে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। অথচ পুরো হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। এতে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, মির্জা আযম, তোরাব আলীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অভিযুক্তদের অনেকেই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দেশে ফেরত এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পিলখানা হত্যার ঘটনায় ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছে শহীদদের পরিবার। পাশাপাশি ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এটি তদন্ত করে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশার সঙ্গে জড়িতদের নাম ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। তদন্তের ক্ষেত্রে পিলখানার ওই নারকীয় তাণ্ডব থেকে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি, সামরিক বাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, ডিজিএফআই, এনএসআই, হুকুমদাতা; সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিদেশি-সংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তদন্ত শেষ হলে গোটা জাতি এ বিষয়ে জানতে পারবে।’

যা বলছেন স্বজনরা

পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডে যারা নেপথ্য থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। যেহেতু ঘটনাটি কমিশন তদন্ত করছেÑ এই নেপথ্যের খলনায়কদের যেন জাতির সামনে আনা হয়। আমরা ইতোমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছি। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

তিনি বলেন, বাবা-মাকে এভাবে নির্মমভাবে হারানোর ট্রমা থেকে আজও বের হতে পারিনি। এখনও ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে পড়ি। বাবা-মায়ের স্মৃতিগুলো মনে আগলে বেঁচে আছি। কামনা করি, এমন নির্মম ও বর্বর ঘটনা আর কারও জীবনে না আসুক।’

নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহরিন ফেরদৌসী বলেন, ‘আমাদের তিনটি চাওয়া ছিলÑ জাতীয় শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা, দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা ও শহীদের মর্যাদা। দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে ষড়যন্ত্র করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনাটাকে সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, “যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সবার পরিবারই ২৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশেষভাবে পালন করে। এজন্য সম্প্রতি আমরা ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’ করেছি। আগামীকাল (আজ) সকালে আমরা বনানী সামরিক কবরস্থানে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব। এরপর রাওয়া ক্লাবে একটি শোকসভা করা হবে। পরে মিরপুর-২ নম্বরের একটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।”

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী সব সময় আমার সঙ্গে থাকেন। আমি সবাইকে বলি আমাকে অর্ধেক মেহরিন অর্ধেক মুজিব হিসেবে দেখতে। এভাবেই বেঁচে থাকব আমৃত্যু।’

নিহত কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে আইনজীবী সাকিব রহমান বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের প্রাণের দাবি। যেহেতু সম্প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় কোনো বিচারিক ত্রুটি ছিল না, সেহেতু আমরা চাইব হত্যা মামলার আসামিদের যেন জামিন দেওয়া না হয়। পাশাপাশি নেপথ্য খলনায়কদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।’

বিচার কার্যক্রম

পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।

২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।

তবে হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। ফলে হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন।

অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।

এদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ, যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।

এ ছাড়া বিজিবির নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলার বিচার শেষে সারা দেশে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।

কারামুক্ত ১৭৮ সাবেক বিডিআর সদস্য

এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় গ্রেপ্তার জওয়ানদের নিরপরাধ বলে দাবি করেন তাদের স্বজনরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জামিন শুনানি শেষে বিস্ফোরক মামলার আসামিদের জামিনে মুক্তির আদেশ দেওয়া হয়।

আদেশে বলা হয়, যারা বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল নেই, তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। একইভাবে হত্যা মামলায় এরই মধ্যে যাদের সাজা ভোগ সম্পন্ন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি উচ্চ আদালতে আপিল না থাকে, তাহলে তারাও মুক্ত হবেন। তবে কতজন মুক্তি পাচ্ছেন, তা আদেশের দিন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।

শর্তাবলি পর্যালোচনা করে গত ২২ জানুয়ারি ১৭৮ জনের জামিননামা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। পরদিন ২৩ জানুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় জামিন পেয়ে ১৬ বছর পর কারামুক্ত হন ১৭৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য।


Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post