২০ লাখের নিচে ঘুষ নিতেন না সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ

 ২০ লাখের নিচে ঘুষ নিতেন না সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ



সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন দোদুল দুই হাজার কোটি টাকার মালিক; এর সবটাই দুর্নীতিপ্রসূত। কানাডাসহ দেশ-বিদেশে তার অঢেল সম্পদ। তার স্ত্রী মোনালিসা ইসলাম অনলাইন জুয়ার নিয়ন্ত্রক ছিলেন; ‘ক্যাসিনো সম্রাজ্ঞী’ হিসেবে তিনি পরিচিত, এ কথা বলেছেন সাবেক মন্ত্রীরই ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল। মৃদুলের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে।


৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এবং মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মেহেরপুরে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। সরকারি ত্রাণের কোটি টাকার মালামাল আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা এলাকায় থাকলেও মন্ত্রী ও তার ভাইবোন-স্বজন সবাই এখন পলাতক। অথচ ক্ষমতাকালে মন্ত্রী বাইরের ভালো লোক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।১৬মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মিয়াজান আলী বলেন, ‘তার আমলে দল পরিবারতন্ত্রের রূপ নিয়েছিল। জেলা কমিটিতে তার স্ত্রী, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন মিলে ২৩ জন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। মন্ত্রী পঞ্চপাণ্ডব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন।’


তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী গ্রেপ্তার হওয়ায় দলে স্বস্তির হাওয়া বইছে। দলের অস্তিত্বের জন্য এটা দরকার ছিল। তিনি তিনবার এমপি, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হয়ে প্রকৃত নেতাদের ছুড়ে ফেলেন। কর্মীরা মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। মূল্যবান হয়ে উঠেছিল প্রশাসন, পুলিশ ও হাইব্রিড কিছু তোষামোদকারী নেতা।’জানা গেছে, দলকে হাতের মুঠোয় রেখে মন্ত্রী ফরহাদ মেহেরপুরসহ সারা দেশের টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি ও অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। পুলিশকে ব্যবহার করে অনলাইন জুয়া নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে মাসে ৪-৫ কোটি টাকা কামাতেন তার স্ত্রী মোনালিসা ইসলামের মাধ্যমে। তৎকালীন পুলিশ সুপার রাফিউল ইসলাম (সম্পর্কে তার শ্যালক) ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম এ টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন।


অনলাইন জুয়ার হোতাদের সঙ্গে মন্ত্রীর অন্তরঙ্গ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ও অন্যান্য মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিযোগ অস্বীকার করে ডিবির তৎকালীন ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মেহেরপুরে প্রতি মাসে হাজার কোটি টাকার অনলাইন জুয়ার ব্যবসা হয়। এর মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশেও যাচ্ছে। পুলিশ প্রভাবশালীদের চাপে সব নির্মূল করতে পারেনি তবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছে।’


মেহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন বলেন, ‘গত ১০ বছরে পুলিশে, ডিসি অফিসে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ৫০০-এর বেশি নিয়োগ হয়েছে। মন্ত্রীকে ন্যূনতম ২০ লাখ টাকা ঘুষ না দিলে চাকরিই হতো না। ঘুষ ছাড়া মন্ত্রী জেলায় একটি কাজও করেননি। এভাবে তিনি দেশ-বিদেশে একাধিক বাড়ি, দামি গাড়ি, হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’


সারা দেশের শিক্ষা সেক্টরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রীর ছোট ভাই সরফরাজ হোসের মৃদুল; স্থানীয় সমাজসেবা, হাসপাতাল ও থানা নিয়ন্ত্রণ করতেন তার ভাগ্নে (মন্ত্রীর অর্থরক্ষক হিসেবে পরিচিত) আমিনুল ইসলাম খোকন; গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথসহ এলজিইডি নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রীর ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস; সমবায়, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বড় ভাই শহীদ সাদেক হোসেন বাবুল এবং সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের ওষুধ সাপ্লাইবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রী-পত্মীর পিএস জোহা। জনশ্রুতি আছে, এ নিয়ন্ত্রকদের হোতা ছিলেন মন্ত্রী ও তার স্ত্রী। এদের মাধ্যমেই অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি।


সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, তার স্বর্ণ আগে ছিল ২০ ভরি, সর্বশেষ হয়েছে ৪৫০ ভরি; আয় ও সম্পদ সর্বশেষ ২০০ গুণ বেড়েছে। মন্ত্রী এখন ঢাকার কারাগারে এবং তার স্ত্রীসহ অন্য অভিযুক্তরা পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।


মন্ত্রীর দুর্নীতির কথা ফাঁস করেছেন তারই ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল। তিনি এক অডিও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাইয়ের দুর্নীতির কারণেই আজ আমরা সবাই ঘরছাড়া, পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং মামলার আসামি হয়েছি। ফরহাদ হোসেন নিয়োগ, বদলিবাণিজ্য প্রভৃতি দুর্নীতির মাধ্যমে ন্যূনতম দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কানাডার বেগমপাড়ায় তার বাড়ি আছে। ঢাকায় একাধিক বাড়ি আছে। সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন মন্ত্রী ও তার স্ত্রী। টাকা ছাড়া টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি কিছুই হতো না।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীর স্ত্রী মোনালিসা ক্যাসিনো সম্রাজ্ঞী হয়ে পুলিশের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন। ক্ষমতা হারানোর পর ৫০ কোটি টাকা দিয়েছেন মামলা থেকে রক্ষা পেতে। তাই তার নামে কোনো মামলা হয়নি। স্ত্রীর কারণেই আমার ভাই নষ্ট হয়েছে।’

Post a Comment

Previous Post Next Post